December 5, 2024, 10:35 pm
॥ মুসফিকা আঞ্জুম নাবা ॥
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি। আমাদের দেশে পরিচিত-অপরিচিত অনেক আকর্ষণীয় পর্যটন স্থান রয়েছে। বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে যুগে যুগে ভ্রমণকারী ও পর্যটকরা মুগ্ধ হয়েছেন। এসবের মধ্যে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন, ঐতিহাসিক মসজিদ এবং মিনার, পৃথিবীর দীর্ঘতম প্রাকৃতিক সমুদ্র সৈকত, পাহাড়, অরণ্য, বিস্তীর্ণ হাওর, চা বাগানসহ ইত্যাদি অন্যতম। এদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য পর্যটকদের মুগ্ধ করে। বাংলাদেশের প্রত্যেকটি এলাকা বিভিন্ন স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে বিশেষায়িত। বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত হচ্ছে বাংলাদেশের কক্সবাজার। বাংলাদেশে রয়েছে একমাত্র পাহাড়ঘেরা দ্বীপ মহেশখালিসহ আর ও অনেক আকর্ষণীয় পর্যটন স্পট। আছে সুন্দরবন সংলগ্ন ‘করমজল’ পর্যটন কেন্দ্র। যা পর্যটকদের অভিভূত করে।
‘করমজল’ বাংলাদেশের একটি অতিসম্ভাবনাময় নয়নাভিরাম পর্যটন কেন্দ্র। এটি পর্যটন কেন্দ্র সুন্দরবনের পশুর নদীর তীরে অবস্থিত। বন বিভাগের তত্ত্বাবধানে মংলা সমুদ্রবন্দর থেকে প্রায় ৮ কিলোমিটার দূরে ৩০ হেক্টর জমির উপর পর্যটন কেন্দ্রটি গড়ে তোলা হয়েছে। প্রকৃতির শোভা বাড়াতে এখানে রয়েছে কুমির, হরিণ, রেসাস বানরসহ নানা প্রজাতির পশুপাখি। এছাড়াও নির্মিত হয়েছে কাঠের ট্রেইল এবং টায়ার। জেলেদের মাছ ধরার কর্মজজ্ঞ এই পর্যটন কেন্দ্র অতিরিক্ত প্রাপ্তি। বাংলাদেশের একমাত্র কুমিরের প্রাকৃতিক প্রজনন কেন্দ্রটি করমজলে অবস্থিত।
মংলা থেকে ইঞ্জিন চালিত জালিবোট ও লাইফবোটে করে করমজল পর্যটন কেন্দ্রে পৌঁছাতে এক থেকে দেড় ঘণ্টা সময় লাগে। পর্যটন কেন্দ্রের প্রথমেই রয়েছে সুন্দরবনের মানচিত্র, যা সুন্দরবন সম্পর্কে প্রথমিক ধারণা নিতে খুবই সহায়ক হয়। সামনে আঁকাবাঁকা কাঠের তৈরি মাঙ্কি ট্রেইল নামের হাঁটা পথ ধরে এগিয়ে গেলে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্যের সমৃদ্ধতা সম্পর্কে অনুমান করা যায়। এই পথে এগিয়ে পশুর নদীর দেখা পাওয়া যায় চাইলে সেখানে নির্মিত বেঞ্চে বসে বিশ্রাম নেয়া যাবে। সেখান থেকে প্রায় আধা কিলোমিটার দক্ষিণে পথের মাথায় একটি শেড রয়েছে। এই জায়গা থেকে পশ্চিম দিকে আরও একটি কাঠের নির্মিত ট্রেইল দেখতে পাওয়া যাবে। এই পথ আপনাকে নিয়ে যাবে কুমির এবং হরিণ প্রজনন কেন্দ্র এবং পর্যবেক্ষণ টাওয়ারে। এই টাওয়ার থেকে আশেপাশের সৌন্দর্য দেখা যাবে। ওয়াচ টাওয়ার পাশ থেকে যাওয়া যায় ঝুলন্ত ব্রীজে যা আরো ১কিলোমিটার গভীর জঙ্গলে নিয়ে যায়। এই ব্রীজে ধরে হাটলে শরীরে শিহরণ জেগে ওঠে।
বিশ্বের সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ সুন্দরবন। সুন্দরবনকে বাংলাদেশের ফুসফুস বলা হয়। সুন্দরবনে রয়েছে বেশ কয়েকটি সৌন্দর্যম-িত স্থান রয়েছে । যেমন: নীলকল, কটকা, হারবাড়িয়া, করমজল, দোবেকি শেখের টেক মন্দির, কালিচর মান্দারবাড়িয়া সমুদ্র সৈকত ইত্যাদি। তবে তাদের মধ্যে অন্যতম একটি স্থান হচ্ছে করমজল। করমজল পর্যটন কেন্দ্রে প্রতিবছর হাজার হাজার পর্যটক বেড়াতে আসেন। বিভিন্ন রকমের গাছপালার অসাধারণ সমারোহ বিন্যাস এবং বন্যপ্রাণীর অনন্য সমাবেশ এ বনভূমিকে এক অপরূপ প্রাকৃতিক নিদর্শন হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করছে। করমজলে সবুজ গাছের ফাঁকে ফাঁকে মায়াবী হরিণের প্রাণোচ্ছলতা আর তিড়িং বিড়িং ছুটে চলার সৌন্দর্য বানরের বাঁদরামি ও অসংখ্য পাখির কলরব সবাইকে মুগ্ধ করে তোলে। মংলা বন্দর থেকে সামান্য দূরে বন বিভাগের তত্ত্বাবধানে ৩০ হেক্টর জমির উপর পর্যটন কেন্দ্রটি গড়ে তোলা হয়েছে। এছাড়াও নির্মিত হয়েছে কাঠের ট্রেইল এবং টাওয়ার । পুরো ট্রেইল জুড়েই দেখা মিলবে সুন্দরবনের অন্যতম বাসিন্দা রেসাস বানরের। বানরগুলো পর্যটকদের কাছে চলে আসে।
করমজলের প্রধান আকর্ষণই হচ্ছে হরিণ, কুমির, বানর, কাঠের ট্রেইল, ওয়াচ টাওয়ার, নৌকা চালনা, জেলেদের মাছ ধরার দৃশ্য, সবুজ বনবনানীসহ নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। পর্যটকদের সুবিধার্থে সুন্দরবনের অভ্যন্তরীণ চিত্র অবলোকনের জন্য দেড় কিলোমিটার কাঠের ট্রিল তৈরি করা হয়েছে। পর্যটন কেন্দ্রের প্রথমেই রয়েছে সুন্দরবনের মানচিত্র। সেখান থেকে সুন্দরবনের প্রাথমিক ধারণা পাওয়া অনেকটা সহজ হয়ে যায়। সামনে আঁকাবাঁকা কাঠের তৈরি মাঙ্কি ট্রেইল পথ ধরে এগিয়ে গেলে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্যের সমৃদ্ধতা সম্পর্কে অবগত হওয়া যায়। এই পথে এগিয়ে গেলে পশুর নদীর দেখা মেলে। কাঠ বিছানো পথের দুই ধারে ঘন জঙ্গল। দুই পাশে বাইন, কেওড়া আর সুন্দরী গাছের সারি। সেখান থেকে প্রায় আধা কিলোমিটার দক্ষিণে পথের মাথাই একটি শেড রয়েছে। এই জায়গা থেকে পশ্চিম দিকে আরও একটি কাঠের নির্মিত ট্রেইল দেখতে পাওয়া যাবে। এই পথ ধরে যাওয়া যাবে কুমির এবং হরিণের প্রজনন কেন্দ্র এবং পর্যবেক্ষণ টাওয়ারে। এই টাওয়ার থেকে আশেপাশের সৌন্দর্য দেখা যায়। টাওয়ারের পাশ থেকে যাওয়া যায় ঝুলন্ত ব্রীজে যা আরো গভীর জঙ্গলে গেছে। কাঠের তৈরি ট্রেইলের শেষ প্রান্তে প্রজনন কেন্দ্রটি। সামনেই ছোট ছোট অনেকগুলো চৌবাচ্চা। কোনটিতে ডিম ফুটে বের হওয়া কুমির ছানা, কোনটিতে মাঝারি আকৃতির আবার কোনটিতে আরও একটু বড় বয়সের লোনা জলের কুমিরের বাচ্চা। একেবারে দক্ষিণ পাশে দেয়ালঘেরা বড় পুকুরে আছে রোমিও, জুলিয়েট আর পিলপিল। ২০০২ সালে জেলেদের জালে ধরা পড়া এই তিন লোনা পানির কুমিরকে সুন্দরবনের করমজলে আনা হয়। রোমিও-জুলিয়েটের বয়স এখন ২৩ ।
জুলিয়েট এ পর্যন্ত ডিম দিয়েছে মোট ৪৮২টি। সেখান থেকে ২৮৪টি বাচ্চা ফুটিয়েছেন বন্য প্রাণী প্রজনন ও সংরক্ষণ কেন্দ্রেটির কর্মীরা। করমজলে বন্য প্রাণী প্রজনন ও সংরক্ষণ কেন্দ্রের আরেক নারী সদস্য পিলপিল। এখন পর্যন্ত সে ডিম দিয়েছে ৪৪টি যা থেকে বাচ্চা ফুটেছে ৩৩টি । লোনা পানির এই প্রজাতির কুমির আশি থেকে একশো বছর বাঁচে। এর পাশেই চিড়িয়াখানার মতো খাচায় ঘেরা খোলা জায়গা। ভেতরে চিত্রা হরিণ। খাঁচার ভেতরে পশ্চিম কোণে ছোট আরেকটি খাঁচা। ভেতরে রয়েছে কয়েকটি রেসাস বানর। পর্যটকদের জন্য সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয় হলো সুন্দরবনের বিভিন্ন প্রজাতির উদ্ভিদ ও বন্য প্রাণীর সাথে পরিচিত হতে পারেন অনায়াসে। পরিচিতির সুবিধার্থে এখানে বিদ্যমান গাছের সাথে নামফলক যুক্ত করে রাখা আছে। বস্তুত, সুন্দরবন নানা ধরনের প্রাণী বৈচিত্র্যে অনন্য। এখানে স্থলজ, জলজ, স্তন্যপায়ী, সরীসৃপ উভয়চর প্রাণীসহ বিভিন্ন রকমের প্রাণীর বসবাস রয়েছে । রয়েল বেঙ্গল টাইগার ছাড়াও সুন্দরবনের প্রাণীর মধ্যে রয়েছে চিত্রা হরিণ, মায়া হরিণ, রেসাস বানর, বন বিড়াল, সজারু, উদ বিড়াল এবং বন্য শুকর। প্রায় ৩৫ প্রজাতির সরীসৃপের মধ্যে রাজগোখরা, অজগর, কেউটে এবং কয়েক প্রজাতির সামুদ্রিক সাপ উল্লেখযোগ্য। সুন্দরবনের সবচেয়ে বড় সদস্য মোহনার কুমির; এদের সংখ্যা ২শ’-এর কাছাকাছি।
অমেরুদণ্ডী প্রাণীর মধ্যে কতিপয় মোলাস্কা এবং ক্রাসটেসিয়ান গুরত্বপূর্ণ মৎস্যসম্পদ হিসেবে বিবেচিত। প্রজাতিগুলির মধ্যে তালিকাবদ্ধ হয়েছে প্রায় ২৪ প্রজাতির চিংড়ি, ১৪ প্রজাতির কাঁকড়া, কয়েক প্রজাতির শামুক এবং ঝিনুক। সুন্দরবনে বসবাসকারী ৩২০ প্রজাতির পাখির অধিকাংশই স্থানীয় । প্রায় ৫০ প্রজাতির পাখি রয়েছে। তার অধিকাংশই হাঁসজাতীয়। বক, সারস, হাড়গিলা, কাদা-খোঁচা, লেনজা ও হট্টিটিসহ অসংখ্য উপকূলীয় পাখি এখানকার নদীনালার কিনারায় বিচরণ করে। সমুদ্র এবং নদীর উপকূলভাগে দেখা যায় বহু প্রজাতির গাংচিল, জলকবুতর, টার্ন ইত্যাদি। চিল, ঈগল, শকুন মাছরাঙা ইত্যাদিরও দেখা পাওয়া যায় সুন্দরবনে। এছাড়া, কাঠঠোকা, ভগীরথ, পেঁচা, মধুপায়ী, বুলবুল, ফিঙে, বাবুই, ঘুঘু, বেনে, হাঁড়িচাঁচা, ফুলঝুরি, মুনিয়া, টুনটুনি ও দোয়েলসহ রয়েছে নানা ধরনের ছোট ছোট গায়ক পাখি। সুন্দরবনে বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণী ছাড়াও রয়েছে হরেক রকমের গাছগাছালি। এ বনের প্রধান বৃক্ষ প্রজাতি সুন্দরী এবং গেওয়া । এছাড়া পশুর, ধুন্দল, গরান, বাইন, কেওড়া ইত্যাদি গাছও প্রাকৃতিকভাবে জন্মে। অধিকাংশ গাছেরই আছে ঊর্ধ্বমুখী শ্বাসমূল। সুন্দরবনের এই উপরিভাগের সবুজাভ নয়নাভিরাম দৃশ্য প্রকৃতিপ্রেমীকে অভিভূত করে তোলে।
করমজল এলাকায় রাত কাটাতে চাইলে পর্যটন জাহাজে রাত কাটানোর সুযোগ রয়েছে। এছাড়া হিরণপয়েন্টের নীলকমল, টাইগার পয়েন্টের কচিখালী এবং কাটকায় বন বিভাগের রেস্ট হাউজে রাত্রিযাপন করা যায়। নীলকমল ও কচিখালীতে কক্ষ প্রতি ৩০০০ টাকা ভাড়া দিতে হয়। তবে কচিখালীতে ৪ কক্ষ ভাড়া নিলে ১০,০০০ টাকায় থাকা যাবে। কটকা রেস্ট হাউজে রুম নিতে লাগে ২০০০ টাকা। বিদেশী ভ্রমণকারীদের এই সব রেস্ট হাউজে রাত কাটাতে রুম প্রতি ৫০০০ টাকা দিতে হয়। করমজল পর্যটন কেন্দ্র থেকে দিনে ফিরে আসলে মংলায় বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের মোটেল পশুরে থাকা যাবে। এছাড়াও মংলা শহরে সাধারণ মানের হোটেলগুলো আছে। খুলনা ফিরে এলে বিভিন্ন মানের আবাসিক হোটেল পাওয়া যাবে থাকার জন্যে।
বর্তমান বিশে^ পর্যটন অন্যতম শিল্প হিসাবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। বিশে^র অনেক দেশেই পর্যটন এখন জাতীয় আয়ের অন্যতম মাধ্যম। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, ‘করমজল’ বাংলাদেশের পর্যটনগুলোর মধ্যে অন্যতম আকর্ষণ হলেও এই পর্যটন কেন্দ্রকে এখন পর্যন্ত বিশ^মানের করে গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। এমনকি আন্তর্জাতিক পর্যটকদের নেই প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা। তাই দেশের অতিসম্ভাবনাময় ‘করমজল’ পর্যটনকে বিশ^মানের করা গেলে তা জাতীয় অর্থনীতিতে অপার সম্ভাবনার সৃষ্টি করতে পারে। বিষয়টি পর্যটন মন্ত্রণালয় অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিবেচনা করা দরকার।
Leave a Reply