November 21, 2024, 8:35 am
আবু সাইদ বিশ্বোস, সাতক্ষীরাঃ প্রকল্পের পর প্রকল্প, আর কাড়ি কাড়ি টাকা ব্যয় করার পর দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের প্রায় ৬০ লাখ মানুষের পিছু ছাড়ছে না দীর্ঘদিনের পানিবদ্ধতা। ভারি বৃষ্টিতেই পানিবদ্ধতা, প্রায় দুই যুগ ধরে চলা পানিবদ্ধতার দুঃখ স্থায়ী রূপ পেতে যাচ্ছে। সাতক্ষীরা সদর উপজেলা, তালা, কলারোয়া, যশোরের অভয়নগর, মনিরামপুর ও কেশবপুর, খুলনার ডুমুরিয়া, ফুলতলা ও পাইকগাছার মানুষ প্রতি বছর পানিবন্দী হয়ে পড়ছে। ভারী বৃষ্টিতেই তলিয়ে যাচ্ছে কপোতাক্ষ, বেতনাপাড়ের ও ভবদহের জনপদ। ২০০০ ও ২০১১ সালে এ অঞ্চলে এমন বড় ধরনের বন্যা ও জলাবদ্ধতা হয়েছিল। কিন্তু তখন মানুষ এত আতঙ্কিত হয়ে পড়েনি, কেননা ইতোমধ্যে কয়েক হাজার কোটি টাকার অনেক প্রকল্প শেষ হয়েছে বা চলমান রয়েছে। প্রকল্পের পর প্রকল্প যখন ব্যর্থ, জলাবদ্ধতা নিরসনের তেমন কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। এমন অবস্থায় মানুষ বেশি আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে, আসলে এরপর কোনও প্রকল্প নেওয়া হবে, তাদের কী হবে?
চারদিকে শুধু পানি আর পানি। অসহনীয় জনদুর্ভোগ, এক কথায় মানবিক বিপর্যয়। ফসলের মাঠ, মাছের ঘের, খাল-বিল সবই পানিতে একাকার। শোয়ার ঘর, রান্নাঘর ও গোয়ালঘরে পানি। উঠানে কোমর-সমান পানি। বাজারঘাট, ধর্মীয় ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পানি। রাস্তাঘাট ডুবে আছে। স্কুল-কলেজ, মাদ্রাসা বা সরকারি ভবনে আশ্রয় নিয়েছে অনেকে। রান্না করার মত শুকনো জায়গাটুকুও নেই। কোন মতে খাবারই যোগাড় করতে পারলেও টয়লেট করা বিশাল ঝামেলার। অনেকে উঁচু স্থানে পলিথিন ব্যাগে টয়লেট করে। ঠিকমত না ফেললে, তা আবার ভাসতে ভাসতে ঘরবাড়িতে চলে আসে। মানুষ নিজেরাই যখন মহাবিপদে তখন তাদের গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগি নিয়ে আরও এক ঝামেলায়, কোথায় রাখবে তাদের। বিষাক্ত পানির সঙ্গে বসবাসের ফলে অনেকেই চর্ম রোগসহ পানিবাহিত নানা রোগে আক্রান্ত। ঘরে ঘরে সর্দি-জ্বর, পেটের পীড়া, আমাশয়ের মতো রোগ নিত্যসঙ্গী। কৃষি জমি পানির নিচে, বিষাক্ত পানিতে মাছও মারা যাচ্ছে, কাজকর্মও নাই, চারদিকে হাহাকার। অনেকে ভিটেমাটি ছেড়ে আশ্রয় নিয়েছে ভিন্ন কোনও স্থানে আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে বা শহর-বন্দরে। এমন যখন অবস্থা এলাকার মানুষের তখন মরেও শান্তি নেই। সব জায়গায় পানি, মাটি খুঁড়ে মরদেহ দাফন করা বা শ্মশানে তোলার কোনও সুযোগও নেই। মনে হয় শুধু মানুষের চোখের পানিটুকুই বিশুদ্ধ, আর বাকি সব বিষাক্ত। এসব অভিযোগ ভুক্তভোগীদের।
বিশেজ্ঞরা বলছে, বিগত কয়েক দশক বা তার আগে দেশের এই অঞ্চলে যে বিশেষ প্রাকৃতিক পরিবেশ ও জীবনধারা ছিল, বর্তমানে তা আর নেই। নদী, খালবিল, নৌকা, ম্যানগ্রোভ গাছ, ঝোপঝাড়, কৃষিপণ্য, মাছ, পশুপাখি এবং আরও অনেক কিছুর আর দেখা মেলে না। জোয়ার-ভাটার খেলা, গয়না নৌকা, টাবুরে নৌকা, পাল নৌকা, ভাটিয়ালি সুরে গান আর নেই। একসময় কলকাতাসহ বিভিন্ন স্থান পণ্যবাহী জাহাজ এসে ভিড়ত পাটকেলঘাটা, চৌগাছা জাহাজ বন্দরে। ঘাটে ঘাটে ভিড়ত স্টিমার, লঞ্চ। কিছুটা প্রাকৃতিক কারণে আর অধিকাংশটা মনুষ্যসৃষ্ট কারণে সবই নষ্ট হয়ে গেছে। কপোতাক্ষ, বেতনা, শালতা, মরিচাপ, গোয়ালঘেশিয়া, খোলপেটুয়া ইত্যাদি একসময় প্রবহমান ও গতিশীল ছিল, জনপদের জন্য আশীর্বাদ বয়ে আনত; কিন্তু এখন এগুলো মানুষের জন্য ভয়ঙ্কর হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। পলি পড়ে নাব্যতা হারিয়েছে। এখন ঠিকমতো পানি নিষ্কাশিত হয় না।
অন্যদিকে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে এই সরু নদীগুলো দিয়ে সাগরের পানি উপরে উঠে আসছে। উপরের উজান প্রবাহ না থাকায় পলি জমে নদী ভরাট প্রক্রিয়াকে আরও ত্বরান্বিত করছে।
দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে নদী মৃত্যুর পেছনে প্রধান দুটি কারণ দেখছেন পানি বিশেষজ্ঞরা। প্রথমত, এই অঞ্চলের নদী এবং এর উপনদীগুলো পদ্মা নদী এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গের অন্যান্য কয়েকটি নদীর সাথে যুক্ত ছিল। পশ্চিমবঙ্গে ফারাক্কা ব্যারেজ এবং আরও কিছু বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে ভারত পানি প্রত্যাহার করায়এ অঞ্চলের নদীগুলো উজানের পানির প্রবাহ ও উৎস থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। উজানের পানির অভাবে নদীগুলোর তলদেশে পলি জমে গতি হারিয়েছে।
দ্বিতীয়ত, নদী ও তার পার্শ্বে অপরিকল্পিত বাঁধ ও স্থাপনা নির্মাণ যা নদীর স্বাভাবিক প্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করেছে। বিশেষত, ‘সবুজ বিপ্লব’ নামে ১৯৬০ সালের দিকে শুরু হয় উপকূলীয় এলাকায় বাঁধ নির্মাণের কাজ। ১৯৫৪ এবং ১৯৫৫ সালের উপর্যুপরি ভয়াবহ বন্যার পর বন্যার ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে খাদ্য উৎপাদন বাড়ানের লক্ষ্যে ১৯৫৭ সনে জাতিসংঘের অধীনে গঠিত ক্রগ মিশন’র সুপারিশক্রমে উদ্যোগটি গ্রহণ করা হয়। এই পানি নীতিতে এ অঞ্চলের ভূপ্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য, নদীর গতি প্রকৃতি, জীববৈচিত্র ও জীবনযাত্রার প্রণালীর বিষয়টি বিবেচিত হয়নি।
সম্প্রতি পেপার-পত্রিকায় একটি খবর প্রকাশিত হয়েছে যে, সাতক্ষীরা সদর উপজেলার এক প্রভাবশালী ব্যক্তি তালা উপজেলার খেশরা ইউনিয়নের হরিহরনগর মৌজার ৩৩ বিঘা জলমহাল প্রায় সাত বছর ধরে দখল করে আছে। ২০১৭ সালে ঐ ব্যক্তি জাল দলিল ও কাগজপত্র নিয়ে হাজির হয় এবং স্থানীয় প্রশাসন ও জনসাধারণকে বোকা বানিয়ে উক্ত জলমহাল দখল করে নেয়। বিষয়টি নিয়ে স্থানীয় কৃষকরা সাতক্ষীরা অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে মামলা দায়ের করলে আদালত দলিলটি জাল হিসেবে ঘোষণা করে জব্দ করে এবং খাস খাল হিসেবে নতিভুক্ত করার নির্দেশ দেন। কিন্তু জাল দলিলকারী চক্র বিষয়টি সাতক্ষীরা অতিরিক্ত জেলা জজ আদালতে ও হাইকোর্টে আপীল করে। সেখানেও নিম্ন আদালতের রায় বহাল থাকে। এসব কিছুর পরও প্রভাব খাটিয়ে এই চক্র এই জলমহাল দখল অব্যাহত রেখেছে। জাল দলিল বা কাগজপত্র বানিয়ে নদী-খাল-জলমহাল-খাস জমি দখলের এমন অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে এই এলাকায়।
স্থানীয়রা জানান, অনেকে রাজনৈতিক প্রভাবে বা টাকার বিনিময়ে সরকারের উচ্চপর্যায়ের অফিস বা সচিবালয় থেকে নদী-খাল-জলমহাল দীর্ঘমেয়াদী ইজারা নিয়ে যায়। আর একবার এগুলো দখলবাজদের হাতে চলে গেলে তারা যাচ্ছেতাইভাবে ব্যবহার শুরু করে। বিশেষ করে ঘনঘন বাঁধ দেওয়ার কারণে পানির সাধারণ প্রবাহ একেবারে বন্ধ হয়ে যায়।
Leave a Reply