November 21, 2024, 8:58 am
দেশের সর্ব দক্ষিণ-পশ্চিম বঙ্গোপসাগরের অববাহিকায় গড়ে উঠা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভুমি বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য হুমকির মধ্যে পড়েছে। পলিমাটি জমে বনের বেশকিছু খাল ভরাট হয়ে গেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সুন্দরবনে লবণাক্ততা বাড়ছে। বনের নদী-খালে মিঠা পানির প্রবাহ ক্রমশ কমে যাচ্ছে। অতিমাত্রায় লবণাক্ততায় সুন্দরী গাছ মরে যাচ্ছে, বন্যপ্রাণীরাও নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। এর ওপর অবাধে বন্যপ্রাণী শিকার ও নদী-খালে কীটনাশক ছিটিয়ে মাছ ধরার তৎপরতা তো রয়েছেই। এরই মধ্যে ২২ মে আন্তর্জাতিক জীববৈচিত্র্য দিবস উপলক্ষ্যে সাতক্ষীরায় প্রাকৃতিক সম্পদের অপব্যবহার ও বন্য প্রাণীর সংকটাপন্ন অবস্থা সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণের দাবী জানানো হয়েছে।
বন বিভাগ বলছে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলেও বিরূপ প্রভাব পড়তে শুরু করেছে সুন্দরবনে। সমুদ্রে পানির উচ্চতা বাড়ায় প্রাকৃতিক দুর্যোগ ছাড়াও পূর্ণিমা ও আমাবস্যার জোয়ারে সুন্দরবনের অনেক উঁচু এলাকা তলিয়ে যাচ্ছে। পানিতে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে বন্যপ্রাণীর ডিম। যাতে ব্যাহত হচ্ছে বণ্যপ্রাণীর বংশবিস্তার। উজান থেকে মিঠা পানির প্রবাহ না থাকায় মিঠা পানির স্বল্পতা দেখা দিচ্ছে।
বিশ্বব্যাংকের এই প্রতিবেদন অনুযায়ী, বনে ৫২৮ প্রজাতির বৃক্ষ ও লতাগুল্ম রয়েছে, রয়েছে ৩০০ প্রজাতির পাখি। ৫৮ প্রজাতির সরীসৃপ, ৪২ প্রজাতির স্তন্যপায়ী এবং ৯ প্রজাতির উভচর প্রাণী সুন্দরবনে চড়ে বেড়ায়। সুন্দরবনের নদী-খালে ২৫০ প্রজাতির মাছ, বহু প্রজাতির কীটপতঙ্গ, কাঁকড়া, শামুক-ঝিনুক রয়েছে। রয়েছে নানা ধরনের ছত্রাক, শেওলা। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক এক গবেষণায় সুন্দরবন সংলগ্ন নদ-নদীতে ১৭ প্রজাতির মাছের দেহে মাইক্রো প্লাস্টিক পাওয়া গেছে। এসব মাছ খেলে মানুষের লিভার ক্ষতিগ্রস্থ হয়, আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা আছে প্রাণঘাতী ক্যানসারেও। অভিযোগ রয়েছে, স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি ও বন বিভাগের অসৎ কর্মকর্তাদের যোগসাজশে প্রতিনিয়ত সুন্দরবনের গাছ চুরি, অভয়াশ্রমে বিষ দিয়ে শিকার, বন্যপ্রাণী শিকার ইত্যাদি ধ্বংসাত্মক কর্মকান্ড পরিচালিত হচ্ছে।
বিশেজ্ঞরা বলছে, সাতক্ষীরার সুন্দরবন উপকূলসহ দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে আশির দশক থেকে নদী থেকে লোনাপানি নিয়ে ঘেরে চিংড়ি চাষ করা হয়। বিশেষ করে সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার সুন্দরবন সংলগ্ন গাবুরা, বুড়িগোয়ালিনী, মুন্সিগঞ্জ, রমজানগর, কৈখালী, কাশিমাড়ী এলাকায় ১০ হাজারের বেশি মাছের ঘের এবং এক হাজারের বেশি কাঁকড়ার খামার আছে। এসব ঘেরে সুন্দরবন থেকে আহরিত চিংড়ি রেণুর চাহিদা অনেক। ফলে জেলেরা সুন্দরবনের নদী থেকে ঘন জাল ব্যবহার করে চিংড়ি সংগ্রহ করেন। পরে চিংড়ি রেণু বেছে আলাদা করে জালে থাকা অন্যান্য মাছের পোনা ও অনুজীবগুলো মাটিতে ফেলে দেন। ফলে সেগুলো মারা যায়।
এদিকে জীববৈচিত্র্য সম্পর্কে বিশ্ববাসীকে সচেতন করতেই জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচি ২২ মে দিনটি বিশ্ব জীববৈচিত্র্য দিবস হিসেবে পালন করে আসছে। এরই অংশ হিসেবে শ্যামনগর উপজেলার বুড়িগোয়ালিনীতে সিএনআরএস-সিডা-বিফোআরএল প্রকল্পের উদ্যোগে আন্তর্জাতিক জীববৈচিত্র্য দিবস-২০২৪ পালিত হয়েছে। বুধবার (২২ মে) বিকাল সাড়ে ৪টায় বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নে দাতিনাখালী গ্রামে আদিবাসী মুন্ডা কমিউনিটির নারীদের অংশগ্রহণে দিবসটি যথাযোগ্য মর্যাদায় পালিত হয়েছে। সুইডিশ দূতাবাসের অর্থায়নে সেন্টার ফর ন্যাচারাল রিসোর্স স্টাডিজ (সিএনআরএস)এর বাস্তবায়নাধীন, বায়োডাইভার্সিটি ফর রেসিলিয়েন্ট লাইভলিহুডস (বিফোরআরএল) প্রকল্পের উদ্যোগে দাতিনাখালী গ্রাম থেকে র্যালি শুরু করে নদী ভাঙন কবলিত বাঁধ এলাকা পরিদর্শন করে আবার গ্রামে গিয়ে শেষ হয়। এছাড়া দুপুরে সাতক্ষীরা প্রেসক্লাবের সামনে এই মানববন্ধনের আয়োজন করা হয়। মানববন্ধনে সাতক্ষীরা জেলা নাগরিক কমিটির আহবায়ক আজাদ হোসেন বেলালের সভাপতিত্বে সংহতি প্রকাশ করে বক্তব্য রাখেন, সিনিয়র সাংবাদিক কল্যাণ ব্যানার্জি, মানবাধিকার কর্মী মাধব চন্দ্র দত্ত, নাগরিক নেতা আলী নুর খান বাবুল, শিক্ষক শহীদুল ইসলাম প্রমুখ।
মানব বন্ধনে বক্তারা বলেন, দেশে এক সময় ২০ হাজার স্থানীয় জাতের ধান, ৩৬৫ জাতের স্বাদু পানির মাছ, বিস্তীর্ণ হাওর, সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবন, পৃথিবীর বৃহৎ সমুদ্র উপকূল, ৩০টি কৃষি প্রতিবেশ অঞ্চল ও ১৭টি হাইড্রোলজিক্যাল অঞ্চল ছিল। কিন্তু সচেতনতার অভাবে ও অপরিকল্পিত উন্নয়নের ফলে সবকিছু ধ্বংসের মুখে পতিত হচ্ছে। সকল প্রাণের জন্য পরিকল্পিত ও বাসযোগ্য শহর তৈরীর লক্ষ্যে অন্তত ২০ ভাগ বনভূমি এবং ১৫ ভাগ জলাভূমি নিশ্চিতকরণ, নগর উন্নয়ন পরিকল্পনায় সকল শ্রেণী পেশার মানুষের মতামত গ্রহণ ও পরিবেশকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব প্রদান, প্রাণ-প্রকৃতির প্রতি সদয় আচরণ করার জন্য জনসচেতনতা বৃদ্ধি ও মাটির স্বাস্থ্য সুরক্ষায় উদ্যোগ নেওয়ার আহবান জানানো হয় মানব বন্ধ থেকে।
পশ্চিম বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আবু নাসের মোহসিন হোসেন বলেন, ‘সুন্দরবন আমাদের সম্পদ। একে রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদের। সুন্দরবন না বাঁচলে বাংলাদেশ বাঁচবে না, এই সম্পর্কে সন্দেহের অবকাশ নেই। ম্যানগ্রোভ বেঁচে থাকলে, তা শক্তিশালী দেয়াল হয়ে দাঁড়াতে পারবে ঘূর্ণিঝড়ের সামনে। এছাড়া পরিবেশকে সুরক্ষিত রাখতে এই বনকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। এজন্য সংশ্লিষ্ট সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।’তিনি আরও বলেন, ‘একসময় এ বনে বাস করত ৪০০ প্রজাতির পাখি। কমতে কমতে এখন দাঁড়িয়েছে ২৭০ প্রজাতিতে। বিলুপ্ত হয়েছে ১৩০ প্রজাতির পাখি। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাড়ছে সাগর-নদীর পানির উচ্চতা ও লবণাক্ততা। তাই কমে যাচ্ছে কম লবণসহিষ্ণু সুন্দরীসহ অন্যান্য গাছ, কমছে বন্যপ্রাণীর বিচরণ ক্ষেত্রও।’
সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক হুমায়ুন কবির বলেন, সুন্দরবন থেকে কাঁকড়া ও চিংড়ি আহরণের ঘের সংক্রান্ত নীতিমালা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এছাড়া জেলা ব্যাপি জীববৈচিত্র্য রক্ষায় সরকার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে।
Leave a Reply