নাছির উদ্দিন শোয়েব : বহুল আলোচিত বরগুনার রিফাত শরীফ হত্যা মামলায় তার স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নিসহ ছয়জনের ফাঁসির আদেশ দিয়েছেন আদালত। গতকাল বুধবার দুপুরে বরগুনার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক মো. আসাদুজ্জামান এ রায় ঘোষণা করেন। রায়ে প্রাপ্ত বয়স্ক ১০ জনের মধ্যে ছয়জনের মৃত্যুদণ্ড ও চারজন খালাস পেয়েছেন। এই রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেছেন, রিফাত শরীফ হত্যাকাণ্ডের মাস্টারমাইন্ড ছিলেন মিন্নি। তারই পরিকল্পনায় রিফাতকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না দিলে যুবকরা ধ্বংসের পথে যাবে।
রায়ের প্রতিক্রিয়ায় রিফাতের বাবা আবদুল হালিম দুলাল শরীফ বলেন, ‘এই রায়ে আমরা সন্তুষ্টি প্রকাশ করছি। তবে রায়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়ে মিন্নির বাবা মোজাম্মেল হোসেন কিশোর দাবি করেন, তাদের প্রতি অবিচার করা হয়েছে। এদিকে রায় প্রত্যাশিত হয়নি বলে মন্তব্য করেছেন আসামী মিন্নির আইনজীবী মাহবুবুল বারী আসলাম। তিনি উচ্চ আদালতে যাওয়ার কথা জানিয়েছেন। চাঞ্চল্যকর এ মামলার রায় ঘিরে সকাল থেকেই বরগুনার আদালত প্রাঙ্গণ ও আশপাশের এলাকায় কঠোর নিরাপত্তাবেষ্টনী গড়ে তুলেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। রিফাতের বাবা আব্দুল হালিম দুলাল শরীফের নিরাপত্তায় পুলিশ দেয়া হয়েছে।
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তরা হলেন- রিফাতের স্ত্রী আয়শা সিদ্দিকা মিন্নি, রাকিবুল হাসান ওরফে রিফাত ফরাজী (২৩), আল কাইয়ুম ওরফে রাব্বি আকন (২১), মোহাইমিনুল ইসলাম সিফাত (১৯), রেজোয়ান আলী খান হৃদয় ওরফে টিকটক হৃদয় (২২) ও হাসান বন্ড (১৯)। এছাড়া মুসা বন্ড (২২), রাফিউল ইসলাম রাব্বি (২০), সাগর (১৯) ও কামরুল হাসান সায়মুনকে (২১) খালাস দেয়া হয়েছে। মামলার প্রধান আসামী নয়ন বন্ড গ্রেফতারের পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়।
দুপুর পৌনে দুই টায় আলোচিত এ মামলার রায় ঘোষণা করেন বিচারক। আগেই বাবার সঙ্গে মোটরসাইকেলে চড়ে আদালতে উপস্থিত হন মিন্নি। হত্যা মামলায় মিন্নিসহ ছয়জনের ফাঁসির আদেশের পরই মিন্নিকে গ্রেফতার দেখিয়েছে পুলিশ। পরে তাকে পুলিশ হেফাজতে নেয়। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী বরগুনার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের পাবলিক প্রসিকিউটর মোস্তাফিজুর রহমান বাবু। তিনি বলেন, রায় ঘোষণার পরপরই মিন্নিকে পুলিশ হেফাজতে নেয়া হয়। ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত সবাইকে কারাগারে পাঠানো হয়। তিনি উচ্চ আদালত থেকে জামিনে ছিলেন।
রায়ের পর রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী সাংবাদিকদের বলেন, ‘কেবল বরগুনা নয়, সারাদেশে আলোচিত ছিল এই হত্যাকাণ্ডটি। এই মামলায় আদালত যে রায় ঘোষণা করেছেন, তাতে আমরা সন্তুষ্ট। আদালত পর্যবেক্ষণে বলেছেন, এই হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন মিন্নি। তিনিসহ ছয়জন হত্যাকাণ্ডে সরাসরি যুক্ত থাকায় আদালত তাদের মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন। বাকি চারজনকে খালাস দিয়েছেন। আমরা রায়ে সন্তুষ্ট। আদালত যাদের খালাস দিয়েছেন, তাদের নিয়ে আমাদের কোনো বক্তব্য নেই। ১৯ জনের সাক্ষ্য নিয়ে সবকিছু বিবেচনায় নিয়ে বিজ্ঞ বিচারক যে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন, তাতে আমরা সম্পূর্ণ সন্তুষ্ট।’ এর আগে, দুপুর পৌনে ১২টার দিকে কারাগার থেকে কঠোর নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে আসামীদের আদালতে আনা হয়। আদালত চত্বরে চাঞ্চল্যকর এই হত্যা মামলার রায় শুনতে হাজির হয় উৎসুক জনতা।
জানা গেছে, রিফাত শরীফ হত্যা মামলায় তার স্ত্রী আয়শা সিদ্দিকা মিন্নিসহ প্রাপ্তবয়স্ক ১০ আসামীর সবার মৃত্যুদণ্ডের প্রত্যাশা করেছিলেন রিফাতের মা-বাবা। রায় ঘোষণার আগে রিফাতের বাবা আবদুল হালিম দুলাল শরীফ বলেন, ‘মিন্নিসহ সব আসামীর শাস্তি চাই আমরা। দেশের বিচার ব্যবস্থার ওপর আমাদের আস্থা আছে। আদালত আমার ছেলের হতাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের এমন শাস্তি দিক, যাতে আমরা স্বস্তি পাই।’ তবে এই মামলার অন্যতম আসামী রিফাতের স্ত্রী মিন্নি তার পরিবারের সদস্যদের জানান, তিনি নির্দোষ। আদালতে খালাস পাবেন তিনি। আদালত চত্বরে মিন্নির বাবা মোজাম্মেল হক কিশোর সাংবাদিকদের বলেন, ‘মিন্নি একটা কথাই আমাকে বারবার বলছে, বাবা আমি নির্দোষ, আমি খালাস পাব। আমিও বিশ্বাস করি, মিন্নি অপরাধ করেনি। সে খালাস পাবে।’ এদিকে মামলার প্রধান আসামী নয়ন বন্ড ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হওয়ায় তাকে মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। এছাড়া মামলার অন্যতম আসামী মো. মুসা এখনো পলাতক রয়েছে। মিন্নি উচ্চ আদালত থেকে শর্তসাপেক্ষে জামিন নিয়ে বাবার বাড়িতে ছিলেন। আর বাকি আসামীরা কারাগারে ছিলেন। রায়ের পর তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এর আগে এ বছরের ১ জানুয়ারি আসামীদের বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করা হয়। আর মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয় ৮ জানুয়ারি।
বাদীর নিরাপত্তায় অস্ত্রধারী পুলিশ মোতায়েন: রায়কে কেন্দ্র করে বাদী নিহত রিফাতের বাবা আব্দুল হালিম দুলাল শরীফের নিরাপত্তায় দুইজন অস্ত্রধারী পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। এছাড়াও নিরাপত্তার আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে রিফাত শরীফের বাড়িও। নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করে বরগুনার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মহরম আলী বলেন, ‘রিফাতের বাবা ও তার পরিবারের নিরাপত্তায় পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। রিফাতের বাবার নিরাপত্তায় সার্বক্ষণিক দুজন গানম্যান তার সঙ্গে থাকবেন।’ রিফাতের বাবা আ. হালিম দুলাল শরীফ বলেন, ‘সার্বক্ষণিক নিরাপত্তায় বরগুনা জেলা পুলিশের দুজন অস্ত্রধারী সদস্য আমার সঙ্গে থাকছেন। এছাড়া বাড়িতে পুলিশ সদস্যরা ডিউটি করবেন।’ পুলিশ মোতায়েনের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে তিনি আরও বলেন, ‘রায়কে কেন্দ্র করে আমাদের ওপর হামলার আশঙ্কা রয়েছে। আমরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছিলাম।
কী ঘটেছিল সেদিন: রিফাত শরীফ বরগুনা জেলা শহরের উত্তর বড়লবণগোলা এলাকার বাসিন্দা মো. আবদুল হালিম দুলাল শরীফের ছেলে। তিনি জেলা শহরে ডিশলাইনের ব্যবসা করতেন। রিফাত ১ নম্বর আসামী নয়নবন্ডের সঙ্গে বরগুনা জিলা হাই স্কুলে পড়াশোনা করেছেন এবং এবং তাদের উভয়ের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। কিন্তু আয়শা সিদ্দিকা মিন্নিকে কেন্দ্র করে তাঁদের মধ্যে বৈরিতা সৃষ্টি হয়। ২০১৯ সালের ২৬ জুন বরগুনা সরকারি কলেজের সামনের সড়কে সকাল ১০টা ১০ মিনিটের দিকে প্রকাশ্যে নয়নবন্ড ও তার সহযোগীরা রিফাতকে কুপিয়ে হত্যা করেন। হত্যাকাণ্ডের সময় রিফাতের স্ত্রী আয়শা সিদ্দিকা মিন্নি ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন। এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় পরদিন ২৭ জুন দুলাল শরীফ বাদী হয়ে ১২ জনের নাম উল্লেখ করে ও অজ্ঞাত আরো পাঁচ-ছয়জনকে আসামী করে সদর থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। মামলায় উল্লেখ করা ১২ আসামী হলেন-সাব্বির আহম্মেদ নয়ন, মো. রিফাত ফরাজী, মো. রিশান ফরাজী, চন্দন, মো. মুসা, মো. রাব্বি আকন, মোহাইমিনুল ইসলাম সিফাত, রায়হান, মো. হাসান, রিফাত, অলি ও টিকটক হৃদয়। মামলার এজাহারে বাদী উল্লেখ করেন, ‘আসামীরা এলাকার চিহ্নিত সন্ত্রাসী, মাদক ব্যবসায়ী ও সেবনকারী। আমার ছেলে মো. শাহনেওয়াজ রিফাত শরীফের সঙ্গে তিন মাস আগে বরগুনা পৌরসভার ২ নম্বর ওয়ার্ডের পুলিশ লাইন মাইঠা গ্রামের মো. কিশোরের মেয়ে আয়শা সিদ্দিকা মিন্নির বিয়ে হয়। বিয়ের আগে মিন্নির সঙ্গে ১ নম্বর আসামী মো. সাব্বির আহম্মেদ নয়ন ওরফে নয়নবন্ডের (২৫) প্রেমের সম্পর্ক ছিল বলে নয়ন দাবি করে। রিফাতের সঙ্গে মিন্নির বিয়ের খবর জানার পর থেকেই নয়ন ও তার সহযোগী অন্য আসামীরা রিফাতকে বিভিন্ন সময় হত্যাসহ নানা রকম ভয়ভীতি ও হুমকি দিতে থাকে। মিন্নি বরগুনা সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে লেখাপড়া করে।’ হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা দিয়ে এজাহারে উল্লেখ করা হয়, গত বছরের ২৬ জুন ঘটনার দিন মিন্নি কলেজে যান। আনুমানিক সকাল ১০টা ১০ মিনিটে রিফাত তার স্ত্রী মিন্নির সঙ্গে দেখা করতে বরগুনা সরকারি কলেজের গেটের সামনে যান। সেখানে ওত পেতে থাকা সব আসামী খুনের এক ও অভিন্ন উদ্দেশ্যে রিফাতকে ঘিরে ফেলে এবং অতর্কিতে ১ নম্বর আসামী নয়ন তার হাতে থাকা ধারালো বগি দা (রামদা) দিয়ে রিফাতকে হত্যার উদ্দেশ্যে ঘাড় লক্ষ্য করে কোপ দেন। এতে রিফাতের গলার ডান পাশের হাড় ও রগ কাটা পড়ে রক্তাক্ত জখম হয়। ওই সময় ২ নম্বর আসামী রিফাত ফরাজী তার হাতে থাকা ধারালো দা দিয়ে কোপ দেয় এবং সেই কোপ রিফাতের বুকের ডান পাশে পড়লে হাড় কাটা পড়ে জখম হয়। একই সময়ে ৩ নম্বর আসামী রিশান ফরাজী তার হাতে থাকা দা দিয়ে রিফাতের মাথায় কোপ দেন এবং এতে তিনি গুরুতর জখম হন। তখন অন্য আসামীরা রিফাতের শরীরের বিভিন্ন স্থানে কুপিয়ে গুরুতর জখম করে রাস্তায় ফেলে চলে যান। পরে স্থানীয় কিছু লোকের সহায়তায় রিফাতকে রিকশায় করে বরগুনা জেনারেল হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে যান মিন্নি। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাঁকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেন। বাদী ঘটনার বর্ণনা দিয়ে এজাহারে আরো উল্লেখ করেন, টেলিফোনে খবর পেয়ে তিনি হাসপাতালে ছুটে যান এবং ছেলের মুখে ঘটনার বিবরণ শুনতে পান। পরে রিফাতের অবস্থার অবনতি হলে তাঁকে বরিশাল শেরেবাংলা মেডিকেলে কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে ঘটনার দিন বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে রিফাত মারা যান। মামলায় সাক্ষী হিসেবে রিফাতের স্ত্রী মিন্নি, আবদুস সালাম, আ. আজিজ শরীফ, মো. মনজুরুল আলম জন, মো. লিটন, আনোয়ার হোসেন মৃধা, মো. জাকারিয়া বাবু, মো. হারুন, আ. হাই আল হাদি, মো. সজলের নাম উল্লেখ করে বলা হয়, মামলায় আরো সাক্ষী আছে।
নৃশংস এ হত্যাকাণ্ডের ভিডিও ফুটেজ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে দেশজুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। চারদিকে শুরু হয় প্রতিবাদ। পুলিশ পরে গত বছরের ১৯ জুলাই পর্যন্ত এজাহারভুক্ত ছয় আসামীসহ ১৪ জনকে গ্রেফতার করে। তবে প্রধান আসামী নয়নবন্ড পুলিশের অভিযানের সময় ২ জুলাই রাত সোয়া ৪টার দিকে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন। এদিকে, হত্যাকাণ্ডের একাধিক ভিডিও ফুটেজ প্রকাশ এবং মিন্নির সঙ্গে মামলার ১ নম্বর আসামী নয়নবন্ডের একাধিক ফোনালাপের খবর ফাঁস হলে ঘটনা নাটকীয় মোড় নেয়। মিন্নিও হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগ ওঠে। এ ঘটনায় রিফাতের বাবা আবদুল হালিম দুলাল শরীফ ১৩ জুলাই বরগুনা প্রেসক্লাবে সাংবাদিক সম্মেলন করে মিন্নির গ্রেফতার দাবি জানান। পরদিন ১৪ জুলাই মিন্নি তার বাড়িতে সাংবাদিক সম্মেলন করেন। এতে তিনি নিজেকে নির্দোষ দাবি করে বলেন, ‘যারা বরগুনায় ‘বন্ড ০০৭’ সন্ত্রাসী গ্রুপ করেছিল, তারা খুবই ক্ষমতাবান ও বিত্তশালী। তারাই মামলাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে আমার শ্বশুরকে দিয়ে চাপ সৃষ্টি করিয়েছে।’ ১৬ জুলাই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের হেফাজতে নিয়ে মিন্নিকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের পর হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে মিন্নিকে এ মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়। পরে তিনি উচ্চ আদালত থেকে জামিনে আসেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here